ঢাকা ১১:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিষমুক্ত সবজিচাষ করেছে কৃষক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩৭:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০১৮
  • ৪০৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দিগন্ত জোড়া মাঠভর্তি সবুজ সবজি। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে যতটা দেখা যায়, সবখানেই সবুজের সমারোহ। কোনোটিতে দেশি শিম। কোনোটিতে কাঁচা মরিচ কিংবা বেগুন। কোনো কোনো ক্ষেতের মাচাংয়ে ঝুলছে সতেজ শসা। সবুজ শাখা-পল্লবের ভেতর উঁকি মারছে লাল টমটো, ক্ষেতজুড়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, স্কোয়াস।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে গোয়ালিয়া খোলা, লাইমিপাড়া, লুলাইনপাড়া, ডলুপাড়া, মুসলিমপাড়া এবং ভরাখালী গেলে এমন দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়।

রাসায়নিক সার নয়। এখানকার চাষিরা তাঁদের জমিতে ব্যবহার করেন নিজেদের তৈরি অর্গানিক সার, কীটনাশক এবং পোকা-মাকড় তাড়ান ভেষজ কীটনাশক ও আলোক ফাঁদ পেতে। ফলে এখান থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি। এসব সবজি প্রতিদিনই বাজারে চলে যাচ্ছে। কিছুটা বাড়তি মূল্যে বিকোচ্ছেও। বান্দরবানে অর্গানিক সার ব্যবহার করে সবজি উৎপাদনের সূচনা ২০১৪ সালে।

বিঘাখানেক জমিতে এই কর্মসূচি শুরু করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্ট।’ এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে ৯টি গ্রামে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের ছাতার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন ৩৫০ চাষি। আওতায় এসেছে প্রায় ৪০০ একর জমি। তাঁদের মধ্যে বাঙালিরা তো আছেনই, মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতির বেশ কয়েকজন চাষির সংখ্যা কম নয়।

সবারই বাড়ির এক পাশে ‘ভার্মি কম্পোস্ট সার’ কিংবা ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট সার’ উৎপাদন কারখানা। কেঁচো দিয়ে জৈবসার উৎপাদন করা হয় বলে একে বলা হয় ‘ভার্মি কম্পোস্ট’। আর গোবর, গো-মূত্র, নানা বর্জ্য উপকরণ, গাছের ছাল-বাকল, চুলার ছাই, বনজ ফুল, বিচি এবং উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয় ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট’।

শঙ্খ নদীর পাড়ঘেঁষা চারদিকে বাগানঘেরা বাড়ির মালিক এয়েনু মারমা। বয়স ৫০ এর কোটায়। তিনিও তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্ট-এর একজন তালিকাভুক্ত চাষি। বাড়ির উঠোনে বসেই কোমর তাঁতে চাদর বুনছেন। পাশে বসে সুতা ঘুরিয়ে সহযোগিতা করছে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে উ মে নু। মাঝে মাঝে সে উঠে গিয়ে একটি কাঠি দিয়ে ড্রামের পানি নেড়ে দিচ্ছে।

এয়েনু জানান, তাঁদের জমির ফসলের প্রয়োজনীয় সব সার তারা নিজেরাই উৎপাদন করছেন। অর্গানিক সার উৎপাদন করতে তাঁদের কোনো বাড়তি শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তিনি নিজে এবং স্বামী-পুত্র-কন্যারা মিলেই কাজ করেন।

গোয়ালিয়াখোলা গ্রামের আবুল বশর অবস্থাপন্ন চাষি। প্রথমে তরঙ্গ কর্মকর্তাদের কথায় তেমন কান দেননি। পরে তাঁদের পীড়াপীড়িতে টিকতে না পেরে সদস্য খাতায় নাম লেখান বছর তিনেক আগে। উৎপাদন এবং লাভের হিসাবে এখন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। শিম, বেগুন, কাঁচা মরিচ এবং স্কোয়াস মিলিয়ে সাড়ে তিন একর জমিতে এবার তিনি বিষমুক্ত সবজি চাষ করেছেন। তাঁর জমিতে প্রতিটি ৮৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের বেগুন ফলিয়েছেন তিনি।

আবুল বশর বলেন, ‘মোদ্দা হিসেবে রাসায়নিক সার আর অর্গানিক সার ব্যবহারে উৎপাদনে খুব একটা ফারাক থাকে না। কিন্তু লাভটা অন্য জায়গায়।’

তিনি জানান, অর্গানিক সার ব্যবহারে ব্যয় অনেক কম। কিন্তু দাম পাওয়া যায় অন্যদের চেয়ে বেশি। এ কারণে একই পরিমাণের সবজি উৎপাদন হলেও অর্গানিক সার ব্যবহারকারীদের লাভ থাকে তুলনামূলকভাবে বেশি।

আবুল বশর বলেন, ‘কেবল টাকার অংকে লাভের হিসাব দেখছেন কেন, আমরা যে নিজেরা বিষমুক্ত সবজি খাচ্ছি-আপনাদেরও খাওয়াচ্ছি, এটি বিবেচনায় নিচ্ছেন না কেন?’

তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্টের বান্দরবান এরিয়া কো-অর্ডিনেটর আবুল কালাম আজাদ। নিজে বগুড়ার লোক হয়েও কাজ করছেন এখানকার চাষিদের কল্যাণে। তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে খুব একটা সাড়া পাইনি। এখন প্রতি মৌসুমেই তালিকাভুক্ত চাষির সংখ্যা বাড়ছে।’

আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁরা টেকনিক্যাল সাপোর্টের দিকে বেশি নজর রাখেন। এ কারণে ডিপ্লোমাধারী কৃষিবিদদের মাঠে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া তাঁদের বড় কাজ।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাষিদের কোনো টাকা দেই না। কারো প্রয়োজন হলে ইনপুট হিসেবে তাঁকে জৈবসার সরবরাহ করি। এর বাইরে অর্গানিক সার তৈরির যে সব উপাদান স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় না, যেমন নিমের তেল, ভেষজ কীটনাশক বিনা মূল্যে সরবরাহ করি। এই অঞ্চলের মাটির ভৌগোলিক গঠন ও টপোগ্রাফি একটু আলাদা। জলবায়ুও প্রভাবও আলাদা। তাই আমরা কিছুটা এক্সপেরিমেন্টও করছি। এতে ব্যাপক সাড়া মিলছে।’

তিনি জানান, চাষিদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে বান্দরবান জেলা সদরের মহিলা ক্লাব কমপ্লেক্সে গত ২১ ডিসেম্বর থেকে একটি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সদর ইউনিয়নের লাইমিপাড়া, লুলাইনপাড়া, কুহালং ইউনিয়নের ডলুপাড়া, মুসলিমপাড়া এবং ভরাখালী গ্রামের চাষীরা বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়মিত সরবরাহ দিচ্ছেন বিষমুক্ত সবজি। জমির পাশে পাইকারদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি জেলা সদরের এই বিক্রয় কেন্দ্রে বিষমুক্ত সবজি বিকোচ্ছেও ভালোই।

আবুল কালাম আজাদ বললেন, ‘তরঙ্গের উদ্যোগে বিষমুক্ত সবজির কিছুটা ধারণা এবং চাষের অভ্যাসতো করা গেছে। সবাই মিলে কাজ করলে বান্দরবান জেলা বিষয়মুক্ত সবজি চাষের ইতিহাসও গড়তে পারে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বিষমুক্ত সবজিচাষ করেছে কৃষক

আপডেট টাইম : ০৫:৩৭:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দিগন্ত জোড়া মাঠভর্তি সবুজ সবজি। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে যতটা দেখা যায়, সবখানেই সবুজের সমারোহ। কোনোটিতে দেশি শিম। কোনোটিতে কাঁচা মরিচ কিংবা বেগুন। কোনো কোনো ক্ষেতের মাচাংয়ে ঝুলছে সতেজ শসা। সবুজ শাখা-পল্লবের ভেতর উঁকি মারছে লাল টমটো, ক্ষেতজুড়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি, স্কোয়াস।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে গোয়ালিয়া খোলা, লাইমিপাড়া, লুলাইনপাড়া, ডলুপাড়া, মুসলিমপাড়া এবং ভরাখালী গেলে এমন দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়।

রাসায়নিক সার নয়। এখানকার চাষিরা তাঁদের জমিতে ব্যবহার করেন নিজেদের তৈরি অর্গানিক সার, কীটনাশক এবং পোকা-মাকড় তাড়ান ভেষজ কীটনাশক ও আলোক ফাঁদ পেতে। ফলে এখান থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি। এসব সবজি প্রতিদিনই বাজারে চলে যাচ্ছে। কিছুটা বাড়তি মূল্যে বিকোচ্ছেও। বান্দরবানে অর্গানিক সার ব্যবহার করে সবজি উৎপাদনের সূচনা ২০১৪ সালে।

বিঘাখানেক জমিতে এই কর্মসূচি শুরু করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্ট।’ এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে ৯টি গ্রামে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের ছাতার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন ৩৫০ চাষি। আওতায় এসেছে প্রায় ৪০০ একর জমি। তাঁদের মধ্যে বাঙালিরা তো আছেনই, মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতির বেশ কয়েকজন চাষির সংখ্যা কম নয়।

সবারই বাড়ির এক পাশে ‘ভার্মি কম্পোস্ট সার’ কিংবা ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট সার’ উৎপাদন কারখানা। কেঁচো দিয়ে জৈবসার উৎপাদন করা হয় বলে একে বলা হয় ‘ভার্মি কম্পোস্ট’। আর গোবর, গো-মূত্র, নানা বর্জ্য উপকরণ, গাছের ছাল-বাকল, চুলার ছাই, বনজ ফুল, বিচি এবং উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয় ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট’।

শঙ্খ নদীর পাড়ঘেঁষা চারদিকে বাগানঘেরা বাড়ির মালিক এয়েনু মারমা। বয়স ৫০ এর কোটায়। তিনিও তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্ট-এর একজন তালিকাভুক্ত চাষি। বাড়ির উঠোনে বসেই কোমর তাঁতে চাদর বুনছেন। পাশে বসে সুতা ঘুরিয়ে সহযোগিতা করছে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে উ মে নু। মাঝে মাঝে সে উঠে গিয়ে একটি কাঠি দিয়ে ড্রামের পানি নেড়ে দিচ্ছে।

এয়েনু জানান, তাঁদের জমির ফসলের প্রয়োজনীয় সব সার তারা নিজেরাই উৎপাদন করছেন। অর্গানিক সার উৎপাদন করতে তাঁদের কোনো বাড়তি শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তিনি নিজে এবং স্বামী-পুত্র-কন্যারা মিলেই কাজ করেন।

গোয়ালিয়াখোলা গ্রামের আবুল বশর অবস্থাপন্ন চাষি। প্রথমে তরঙ্গ কর্মকর্তাদের কথায় তেমন কান দেননি। পরে তাঁদের পীড়াপীড়িতে টিকতে না পেরে সদস্য খাতায় নাম লেখান বছর তিনেক আগে। উৎপাদন এবং লাভের হিসাবে এখন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। শিম, বেগুন, কাঁচা মরিচ এবং স্কোয়াস মিলিয়ে সাড়ে তিন একর জমিতে এবার তিনি বিষমুক্ত সবজি চাষ করেছেন। তাঁর জমিতে প্রতিটি ৮৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের বেগুন ফলিয়েছেন তিনি।

আবুল বশর বলেন, ‘মোদ্দা হিসেবে রাসায়নিক সার আর অর্গানিক সার ব্যবহারে উৎপাদনে খুব একটা ফারাক থাকে না। কিন্তু লাভটা অন্য জায়গায়।’

তিনি জানান, অর্গানিক সার ব্যবহারে ব্যয় অনেক কম। কিন্তু দাম পাওয়া যায় অন্যদের চেয়ে বেশি। এ কারণে একই পরিমাণের সবজি উৎপাদন হলেও অর্গানিক সার ব্যবহারকারীদের লাভ থাকে তুলনামূলকভাবে বেশি।

আবুল বশর বলেন, ‘কেবল টাকার অংকে লাভের হিসাব দেখছেন কেন, আমরা যে নিজেরা বিষমুক্ত সবজি খাচ্ছি-আপনাদেরও খাওয়াচ্ছি, এটি বিবেচনায় নিচ্ছেন না কেন?’

তরঙ্গ ইকো ডেভেলপমেন্টের বান্দরবান এরিয়া কো-অর্ডিনেটর আবুল কালাম আজাদ। নিজে বগুড়ার লোক হয়েও কাজ করছেন এখানকার চাষিদের কল্যাণে। তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে খুব একটা সাড়া পাইনি। এখন প্রতি মৌসুমেই তালিকাভুক্ত চাষির সংখ্যা বাড়ছে।’

আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁরা টেকনিক্যাল সাপোর্টের দিকে বেশি নজর রাখেন। এ কারণে ডিপ্লোমাধারী কৃষিবিদদের মাঠে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া তাঁদের বড় কাজ।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাষিদের কোনো টাকা দেই না। কারো প্রয়োজন হলে ইনপুট হিসেবে তাঁকে জৈবসার সরবরাহ করি। এর বাইরে অর্গানিক সার তৈরির যে সব উপাদান স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় না, যেমন নিমের তেল, ভেষজ কীটনাশক বিনা মূল্যে সরবরাহ করি। এই অঞ্চলের মাটির ভৌগোলিক গঠন ও টপোগ্রাফি একটু আলাদা। জলবায়ুও প্রভাবও আলাদা। তাই আমরা কিছুটা এক্সপেরিমেন্টও করছি। এতে ব্যাপক সাড়া মিলছে।’

তিনি জানান, চাষিদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে বান্দরবান জেলা সদরের মহিলা ক্লাব কমপ্লেক্সে গত ২১ ডিসেম্বর থেকে একটি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সদর ইউনিয়নের লাইমিপাড়া, লুলাইনপাড়া, কুহালং ইউনিয়নের ডলুপাড়া, মুসলিমপাড়া এবং ভরাখালী গ্রামের চাষীরা বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়মিত সরবরাহ দিচ্ছেন বিষমুক্ত সবজি। জমির পাশে পাইকারদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি জেলা সদরের এই বিক্রয় কেন্দ্রে বিষমুক্ত সবজি বিকোচ্ছেও ভালোই।

আবুল কালাম আজাদ বললেন, ‘তরঙ্গের উদ্যোগে বিষমুক্ত সবজির কিছুটা ধারণা এবং চাষের অভ্যাসতো করা গেছে। সবাই মিলে কাজ করলে বান্দরবান জেলা বিষয়মুক্ত সবজি চাষের ইতিহাসও গড়তে পারে।